১৫ বছর ধরে অসংখ্য শালিক পাখিকে খাইয়ে আসছেন তারা। এই করোনা মহামারির চরম সংকটকালেও এই দুই পাখি প্রেমীর পাখিদের খাবার দেয়া একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। খাবারের জন্য প্রতিদিন শত শত শালিক পাখি মিরপুর পৌর শহরের ব্যস্ততম ঈগল চত্বরে ছুটে আসে। সেখানে মিতালী হয় মানুষ আর বুনো পাখির।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তখনো ভোরের আলো ফোটার কিছুটা বাকি। মিরপুর পৌর শহরের ব্যস্ততম ঈগল চত্বরে উড়ে আসছে শত শত শালিক পাখি। বৈদ্যুতিক লাইনের তার বা দোকান ঘরের কার্নিশে সারি বেঁধে বসছে তারা। ধীরে ধীরে ঈগল চত্বরে দোকানিসহ নানা শ্রেণির মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে।
ঈগল চত্বর চিরে যাওয়া রাজপথও ব্যস্ত হয়ে উঠে যানবাহনের চাপে। এরই মধ্যে চা দোকানি ইছাহক আলী ও হোটেল মালিক আনন্দ দেবনাথ মুঠো মুঠো চানাচুর আর পরোটার টুকরো ছড়িয়ে দেন ব্যস্ত রাজপথে। মুহূর্তেই বিদ্যুতের তার আর দোকানের কার্নিশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক উড়ে এসে মহাভোজে যোগ দেয় মনের আনন্দে। এরই মাঝে থেকে থেকে ছুটে চলেছে বিভিন্ন যানবাহন। তবুও শালিকের ঝাঁক নির্ভয়ে খেয়ে চলেছে।
মানুষের গলার শব্দ শুনলেই যে পাখিরা প্রাণ ভয়ে পালায় সেই পাখিরাই এখানে মানুষের সাথে মিলে মিশে যেন একাকার। এক পর্যায়ে ইছাহক আলী চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে দোকানে ঢুকে পড়েন, তখন পাখিগুলোও তার পিছু নেয়। গত ১৫ বছর ধরে এই দুই দোকানি এভাবেই খাবার খাইয়ে পাখিগুলোর বন্ধু হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন ভোরে এমন এক নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করেন ঈগল চত্বরের দোকানি আর পথ চলতি মানুষ।
চা দোকানি ইছাহক আলী বলেন, ‘ভোরবেলা সবার আগে দোকান খুলে দুধ গরম করা পাত্রে লেগে থাকা দুধের পোড়া অংশ চেঁছে তুলে রাস্তায় ছড়িয়ে দিতাম। তখন দু- একটি শালিক পাখি এসে সেগুলো খেয়ে যেত। রোজ সকালেই এমনটি ঘটত। দিন যত গড়ায় শালিকের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে। তখন শালিকগুলোর প্রতি এক ধরনের টান তৈরি হয় আমার। এরপর প্রতিদিন বড় সাইজের এক প্যাকেট চানাচুর বরাদ্দ করলাম ওদের জন্য। এখন তো শত শত শালিক আসে খাবার খেতে। দুটো পয়সা খরচ হলেও ওদের কলতানে যে কি আনন্দ পাই তা বলে বুঝাতে পারব না।’
ইছাহকের দোকানের পাশে আনন্দ দেবনাথের খাবার হোটেল। দিন শেষে কিছু না কিছু খাবার বেঁচে যায়। ইছাহকের দেখাদেখি আনন্দ দেবনাথও শালিকের ভালোবাসায় মজেছেন। তিনিও রোজ শালিকদের ভোজে খাবারের যোগান দেন নিয়মিত।
আনন্দ দেবনাথ বলেন, ‘ওদের তো বাঁচিয়ে রাখা দরকার। ওরা তো আমাদের ক্ষতি করে না বরং উপকার করে।’
স্থানীয়রা বলছেন, ভালোবাসার বিনিময়ে যে অনেক কিছু জয় করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন ইছাহক আর আনন্দ দেবনাথ। ভালোবাসার বিনিময়ে পাখির সাথে তারা দুজন সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এভাবে পাখিদের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে তারা জানান।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, শালিক ফসলবান্ধব পাখি। বিশেষ করে আমন মৌসুমে তারা ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এতে কৃষকদের কীটনাশক খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এই কারণে শালিক পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
তিনি বলেন, ‘শালিক পাখিদের খাবার খাইয়ে মিরপুরের দুই দোকানি একদিকে যেমন মহান কাজ করছেন, তেমনি পাখিদের প্রতি সহানুভুতিশীল হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন।’
কুষ্টিয়া বার্ড ক্লাব সভাপতি এসআই সোহেলও দুই দোকানির এই উদ্যাগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষের কারণে আমাদের অনেক প্রজাতির পাখি আজ বিলুপ্ত প্রায়। সেই পাখিদের ভালোবেসে খাবার খাইয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই দুই দোকানি।’
ইছাহক আর আনন্দের মতো সবাই এগিয়ে আসলে বন্ধ হবে পাখি নিধন, রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য-এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা।